সৈনিকের দৈনন্দিন জীবন – বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (Lifestyle of Bangladesh army)

 আস্থা ও ভালোবাসার স্থান অর্জনেঃ

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সেনাসদস্য অন্যান্য বাহিনী বা সংস্থা থেকে দেশের জনগণের কাছে ভিন্নভাবে সমাদৃত। দেশের মানুষের কাছে যথেষ্ট সেনাবাহিনীর প্রতি যথার্থ সম্মান এবং অবিরাম ভালোবাসা বারংবার প্রতিয়মান হয়েছে। তবে এই ভালোবাসা অর্জনের পিছনে রয়েছে প্রতিটি সেনাসদস্যর অক্লান্ত পরিশ্রম আর দৈনন্দিন অজস্ত্র ঘাম ঝড়ানো প্রশিক্ষণ। শুধু তাই নয়, দেশের যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কার্যকারী অবদান কিংবা যেকোন দায়িত্ব পেলে তার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে প্রতিনিয়তই আস্থা অর্জন করে চলেছে। আজকের মূল আলোচনা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর সেনাসদস্যদের জীবনমান আসলে কেমন হয়ে থাকে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। 

সকালের সূর্য উঠা এবং অস্ত্র যাওয়ার সাথে বন্ধুত্বঃ 

সেনাবাহিনীর প্রতিটি সেনাসদস্যর দিন শুরুই হয় কায়িক পরিশ্রম দিয়ে এবং দিন শেষও হয় কায়িক পরিশ্রম বা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। যেমন – ভোর ৫ টার দিকে একজন সৈনিক ঘুম থেকে উঠে। এরপর, ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়া সম্পন্ন করে প্রস্তুতি নেয় সম্মিলিত সামরিক পিটিতে অংশগ্রহণের জন্য। (শীত ও গ্রীস্মকালে ভিন্ন সময় নির্ধারণ হয়)। শীতকালে ৫.৪৫ এ মাঠে সবাইকে উস্থিত হতে হয় এবং সকাল ৬ টায় পিটি শুরু হয়ে যায়। এই ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রথম ৫ মিনিটে সবাই “ ইন থ্রিস ফলিং ” বা সামরিক শৃঙ্খলার সহিত লাইনে দাঁড়ানো সম্পন্ন করেন। পরের ৫ মিনিটে রিপোর্ট হয় যে সবাই আসছে কিনা যদি কেউ অনুপস্থিত হয় তার যথাযথ কারণ বের করা হয় এবং গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়া গেলে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়। শেষের ৫ মিনিটে ইউনিটের দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গ থেকে ধাপে ধাপে উপরোস্থ কর্তৃপক্ষর নিকট প্যারেড স্টেট বা জনবলের হিসাব বিবরণীর লিখিত কপি স্থানান্তর করা হয়। এভাবে এডজুটেন্ট থেকে অন্যান্য অফিসার ধাপ অতিক্রম করে ইউনিট অধিনায়কের কাছে রিপোর্ট যায় যে, কত জন পিটিতে অংশগ্রহণ করেছে এবং কত জন করেনি বা কি কারণে তথা কোন দায়িত্বের কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তা লিপিবদ্ধ থাকে। এরপর ৬ টা বাজার সাথে সাথেই পিটি শুরু হয়ে যায়। প্রথমে স্ট্রেচিং বা শরীরকে প্রস্তুত করতে হালকা নির্ধারিত ব্যায়াম করানো হয় এবং ৬ টা ১০ এ সম্মিলিত দলে দলে বিভক্ত হয়ে দৌড় শুরু হয়ে যায়। সাধরণত প্রতিদিন ৩ কিঃ মিঃ রাস্তা দৌড়ানো হয়। সেনানিবাসের ইউনিট ভিক্তিক নির্ধারিত এলাকায় এই শারিরীক চর্চা করানো হয়। দৌড়ে শেষে মাঠে এসে ৬ টা ৫০ পর্যন্ত নানা ধরেণে পদ্ধতিকে সামরিক শারিরীক চর্চা করানো হয়। শেষের ১০ মিনিট কুল ডাউন বা শীতলকরণ করানো হয় অর্থাৎ রিলাক্স বা সাধারণ ব্যায়াম। এভাবে সকালের পিটি শেষ হয়। এরপর হাতে থাকে এক ঘন্টা সময়। যার মধ্যে ঘাম ঝড়ানো ড্রেস ধৌত করে এবং ফ্রেশ হয়ে দ্রুত সকালের নাস্তা বা ব্রেকফাস্ট সম্পন্ন করতে হয়। কারণ ৮ টার সময় দিনের দ্বিতীয় কার্যক্রম শুরু হবে। সেই উদ্দেশ্যে সবাইকে ৮ টার সময় মাঠে ইন থ্রিস বা সামরিক কায়দায় লাইনে মাঠে লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এরপর দায়িত্বরত ব্যক্তি কর্তৃক ইউনিটের বিভিন্ন দিনের কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। কেউ বা কোন দল যাবে অফিসের কাজে (ক্লার্ক বা অফিস দায়িত্বপালনকারীরা), কেউ যাবে রেশনের গাড়ি আনলোড করতে এবং স্টোরে রেশন ড্রেসিং করে রাখতে; কেউ কেউ  যাবে এলাকার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে ; আবার কেউ যাবে প্রশিক্ষনে বা ক্লাসে কিংবা প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে।

এভাবে দুপুর ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত (শীত এবং গ্রীস্ম কালে ভিন্ন ভিন্ন সময়) অফিসের সময় হিসেবে কাজ সম্পন্ন হয়। এই কার্যক্রমে আবার ১০.৩০ মিনিট এর দিকে টি-ব্রেক থাকে অর্থাৎ হালকা নাস্তা এবং চা এর ব্যবস্থা থাকে তথা “ চা বিরতি ” দেয়া হয়। এভাবে অফিস টাইম সম্পন্ন হয়। অফিস ব্রেকের পর, সকলেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিজ নিজ রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে গোসল সম্পন্ন করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সময় হিসেবে নিজের মত করে সময় পার করবে (অবশ্যই শৃঙ্খলার বহির্ভূত কোন কার্যক্রম নয়)। বিকাল ৪.৩০ এর দিকে গেইমস পিরিয়ড বা খেলাধুলার সময়। তাই ম্যাক্সিমাম সবাই দুপুরে ঘুমানোর চেস্টা করে ( যদি কারো ব্যক্তিগত কোন অন্যান্য কাজ না থাকে বা এটা নিজের ব্যাপার)। এরপর গেইমসের সময় হওয়ার পূর্বে  বাঁশি বাজানো হয় (প্রতিটি কার্যক্রম বা জরুরী যেকোন প্রয়োজনে সবইকে একত্রিত করতে বাঁশি দেয়া হয়), সবাই ফ্রেশ হয়ে গেইমসে চলে যায়। এক ঘন্টা বিভিন্ন খেলাধুলার মধ্য দিয়ে গেইমস পিরিয়ড সম্পন্ন হয়। গেইমসের পরে, সবাই ফ্রেশ বা গোসল সম্পন্ন করেন। এর পর পোশাক পরিধান করে (ফুলহাতা শার্ট-প্যান্ট এবং কালো শু) সবাই রাতের খাবার সম্পন্ন করে। কারণ সন্ধ্যা ৭ টা রোলকল থাকে। তাই ৭ টার পূর্বেই সবাই রাতের খাবার খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করেন (রাতের খাবারের সময় নিয়ে নিশ্চয়ই কৌতহল বোধ হচ্ছে? কিন্তু এটাই বাস্তব)। রোলকল শেষে ব্যক্তিগত সময় শুরু। আর এভাবেই সকালের সূর্য উঠা থেকে সূর্য অস্ত্র যাওয়া অবদী চলে নানা কায়িক পরিশ্রমের কাজ। এমননি অনেক সৈনিক গণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য দুপুরে ঘুমানো বা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগও পাননা। এ যেন সত্যিই সূর্যের উদয় এবং অস্ত্র যাওয়ার সাথে নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

রাতের কার্যক্রমঃ

সাধারণ রাত ১০ টা অবদী বিনোদন রুম খোলা থাকে যেখানে টিভি দেখার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন ক্লাবোর্ড , দাবা, টেবিল টেনিস, লুডু, ইত্যাদি। এছাড়াও লাইব্রেরি সেকশনে বই পড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে অবশ্যই রাত ১০ টা বাজার সাথে সাথে প্রতিটি রুমের আলো বন্ধ করা বাধ্যতামূলক তথা রাত ১০ টার মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সেনাসদস্য ঘুমিয়ে পড়বে এটাই আদেশ (যদিও অনেকেই মোবাইল বা ল্যাপটপে আরো কিছুটা সময় বিনোদনে ব্যস্ত থাকেন কিংবা পরিবারের সাথে মোবাইলে কথপোকথন সম্পন্ন করেন। তবে এক্ষেত্রে আবার অন্যকোন সেনাসদস্য ঘুমাতে বিরক্তিবোধ করেলে বা এই বিষয়ে রিপোর্ট দিলে সমস্যা, তাই ম্যাক্সিমাম সেনাসদস্যই ঘুমিয়ে পড়ে)। এগুলো ছিলো ইউনিটে অবস্থান করা সৈনিকদের নিত্য-নৈমিত্তিক কার্যক্রম। কারণ সারাবছরই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ চলমান থাকে বিভিন্ন ইউনিটে।  আর সেই প্রশিক্ষণে নিয়োজিত থাকে অনেক সৈনিকগণ। তাদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রমই প্রধান। যেমন অফিস টাইম পুরোটাই ক্লাস পিরিয়ড এবং রাতে বিনোদন রুমের পরিবর্তে স্ট্যাডি করতে হয়। এভাবে প্রতিটি সেনাসদস্যর দৈনন্দিন জীবন কেটে যায় সামরিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। সকল কার্যক্রমে কোন সৈনিকে সামান্য শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণ দৃশ্যমান বা রিপোর্ট হলেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয় (এটা নির্ভর করে আচরণ বা অপরাধের উপর)।ৎ

ষান্মাষিক এবং বাৎসরিক বাধ্যগত কার্যক্রমঃ

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রতিবছর ষান্মাসক এবং বাৎসরিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত শারিরীক যোগ্যতা পরীক্ষায় পাস করতে হয়। যদি ফেল করে কোন সেনাসদস্য, তাহলে তাকে অতিরিক্ত শরীরচর্চা তথা শাস্তির পাশাপাশি নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। যেমন পিটিতে অকৃতকার্য হওয়া সৈনিকগণ দেশের বাইরে তথা মিশনে যেতে পারেনা এবং পদোন্নতিতেও বিলম্ব হয়, অনকে সময় পদোন্নতি করাই হয়না। সেনাবাহিনীর মত শরীর চর্চার গুরুত্ব বা কঠিনতম ব্যবস্থা দেশের অন্যকোন বাহিনীতে বা চাকুরীতে বিদ্যমান নেই। যদিও এটা বিশ্বের সকল দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোয্য। তবে আবার অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশের সৈনিকদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধায় অনেক নিম্নমানের (বেতন; খাবারের মান; বাসস্থানের মান; স্ব-পরিবার নিয়ে থাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবস্থা; রেশন স্কেল ইত্যাদিতে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ )।

সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং শৃঙ্খলার মানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চয়েই বলতে পারি যে, তারা সর্বদাই প্রশংসার দাবী রাখে। তাদের এই ত্যাগ; অক্লান্ত পরিশ্রম; নিয়মিত ও কঠিন প্রশিক্ষণ এর বিপরীতে যথার্থ আর্থিক সাপোর্ট হিসেবে বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। সকল সেনাসদস্যর দীর্ঘায়ু কামনা করে এই ব্লকটি এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।

আর্মি মাল্টিমিডিয়।

Here You can read about ” কেন একজন সৈনিক দেশের সেরা এবং প্রথম নাগরিক “ . About Bangladesh_Army

Army Multimedia

Army Multimedia is Basically content creator for the army navy and airforce of Bangladesh & International. You Can visit our all social media to learn about the world military. Always video Uploading on Facebook & youtube about the military.

2 thoughts on “সৈনিকের দৈনন্দিন জীবন – বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (Lifestyle of Bangladesh army)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!