সৈনিক শিমুলের স্বপ্ন পূরণ হলোনা (সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত)
প্রারম্ভিক কিছু কথাঃ
সাধারণত বাংলাদেশের ডিফেন্স সেক্টরে তৃতীয় শ্রেনী পদে তথা সেনা নৌ ও বিমান বাহিনী এবং আনসার থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ড পর্যন্ত সৈনিক সমমান বা তার নিম্নপদে যেসকল সদস্যরা চাকুরীতে যোগদান করেন। তাদের মধ্যে ম্যাক্সিমামই বলাচলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের। অনেক অনেক কস্ট; পরিশ্রম ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বড় হওয়া এবং পড়াশোনার সর্বোচ্চ সিঁড়ি পাড় হওয়ার আগেই চাকুরীতে পদার্পণ ঘটে এই সেক্টরে। এর পর প্রশিক্ষণে যত বড়ই কস্ট দেয়া হোক না কেন, শরীরের শেষ সাধ্য টুকু দিয়ে হলেও তারা টিকে থাকে অনেক স্বপ্ন এবং অদম্য সাহস নিয়ে। এভাবে অজস্র ফোঁটা ঘাম ঝড়িয়ে আর সীমাহিন কস্টকে পেরিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মজীবন শুরু হয়। মনের ভিতর শুধু একটাই বাসনা যে, পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতেই হবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সবার মাঝে গর্বের সাথে বেঁচে থাকতে হবে। প্রশিক্ষণে প্রায়ই দেখা যায়, যে সকল প্রার্থীরা পারিবারিকভাবে বেশ আর্থিক-স্বচ্ছলতাবান কিংবা আর্থিকভাবে কোন পিছুটান নেই যাদের। সেই সকল প্রার্থী প্রশিক্ষণ শেষ না করেই, পালিয়ে যায় কিংবা দরখাস্ত দিয়ে থাকে থাকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেয়ার জন্য। আবার এমনও রয়েছে, ট্রেনিং শেষে কিছু দিন যেতে না যেতেই আলালের ঘরের দুলাল যারা রয়েছে বিশেষ করো তথা ভূল করে যারা অতি আবেগে এই সেক্টরে যোগদান করে ফেলে তারা চাকুরী থেকে অব্যাহতির জন্য দরখাস্ত ক্রমান্বয়ে দিতেই থাকে।
আশা করছি এই টুকু বোঝাতে পেরেছি। এবার আসি, সাম্প্রতিক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় সেনাবাহিনীর সৈনিক শিমুলের পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছু কথায়। তার আগে সবাইকে অবগত করার জন্য একটু নিশ্চিত করতে চাই যে, গত ১৬ই আগস্ট ২০২২ তারিখে রোজ মঙ্গলবারসেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের ১৬ ইসিবি ইউনিটের একটি পিকাপ, সেনাসদস্যদের নিয়ে আলীকদম মহা-সড়ক হয়ে থানচির দিকে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে ২৮ কিলো নামক একটি স্থানে, মর্মান্তিক দূর্ঘটনাটি ঘটে। জানা যায় পিকাপটি প্রায় পাহাড়ের ৫০০ ফুট গভীর খাঁদে পড়ে যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ড্রাইভার কর্পোরাল প্রবীর এবং সৈনিক ফরহাদ ও সৈনিক ইব্রাহীম। কিন্তু সৈনিক শিমুল আহমেদের আর পৃথিবীতে থাকা হয়নি। পারিবারিক সকল সমস্যার অবসান না ঘটিয়েই এবং তার ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ না করেই মাত্র ২৮ বছের বয়সেই পাড়ি জমাতে হলো না ফেরার দেশে।
সৈনিক শিমুলের অপূর্ণ ছোট্ট স্বপ্ন খানিঃ
রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আওতাধীন আড়ানী ইউনিয়নের ঝিনা মিস্ত্রিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা তায়েদ আলীর ছেলে সৈনিক শিমুল আহমেদ। অত্যন্ত গরীর পরিবারের সন্তান ছিলো তিনি। পরিবারটি দীর্ঘদিন যাবত কাঁচা বাড়িতে বসবাস করে আসছিলো। সৈনিক শিমুল ২০১৪ সালে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়। আগামী সেপ্টেম্বর এর দিকে সৈনিক শিমুলের বৈদেশিক মিশনে যাওয়ার কথা ছিলো। তাই সৈনিক শিমুলও মনের গহিনে একটু একটু করে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে যে, মিশন শেষে দেশের ফিরে সবার আগে সাধ্যমত একটা পাঁকা বাড়ি বানাবো; পরিবারকে আরেকটু খুশিতে রাখেবো। আর নিজের ছোট্ট ছোট্ট কিছু না বলা স্বপ্ন গুলোকে এক এক পূরণ করবো। তিনি অনেকের কাছেই প্রকাশ করেছিলেন বলেই আজ আমরাও লিখতে পারছি তার অপ্রাপ্তী বাসনার কথা !
যা কখোনই মেনে নেয়া যায়নাঃ
এতাক্ষণ জেনেছেন পারিবারিক সামগ্রিক দিক থেকে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের অপ্রাপ্তী বাসনার কথা। এবার আসি সবচাইতে বড় কস্টের বিষয়ে। যা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। সৈনিক শিমুল বিবাহিত এবং তার স্বর্ণালী খাতুন নামে ৫ বছরের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। তার স্ত্রীর জ্যামি খাতুন, বর্তমানে তিন মাসের অন্তস্বত্তা তিনি। আগামী দিনের এই সন্তান তার পিতাকে আজন্ম দর্শন করতে পারবে না, এটা ভাবতেই যেন মনের অজান্তেই চোখে পানি এসে যায় । একদিন অনেক আশা নিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলো, “আমার যদি ছেলে সন্তান হয়, তাহলে তোমাদের জন্য আলাদা লম্বা দেখে একটা সময় বের করে, দেশের সবচাইতে সেরা ও সৌন্দর্যে ভরা কোন যায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবো। আর সেটা কোথায় এটা পরে ঠিক করে নেয়া যাবে”। কিন্তু সৈনিক শিমুলের আর সেই ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেলো অজনা কোন এক অন্ধকারে দেশে।
পারিবারিক অন্যান্য সদস্যবৃন্দর সাথে পরিচিতিঃ
সৈনিক শিমুলের মায়ের নাম পপি বেগম (গৃহিণী)। শিমুলের কনিষ্টভ্রাতা সোহাগ আহমেদ তার বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেন এবং ছোটবোন তামান্না খাতুন তন্নি যিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। ছোট ভাই-বোন এবং পরিবারের প্রধান ভরসাযোগ্য জিবীকানির্বাহ কেবল সৈনিক শিমুলই ছিলেন। যদিও সরকার কর্তৃক একটা মোটামোটি ভালো অংকেরই অর্থ প্রদান করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু চাকরী তার কম তাই আনুমানিক সব দিয়ে প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকার মত পাবেন। যা দিয়ে পরিবার ভালোভাবেই চলতে পারবেন ঠিকই। কিন্তু এই অর্থ কি মায়ের কোলের শূন্যতা কিংবা স্ত্রী ও সন্তানদের দুঃখ ঘোচাতে পারবে? নিশ্চয়ই না। এটা কখনই সম্ভব নয়।
সার্বিকভাবে, আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এমন অপ্রত্যাশিত মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় নিহত সেনা সদস্যর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাঁর পরিবারের সকলের এই দুঃখজনক ক্ষতি ও শোক সহ্য করার জন্য, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থণা করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিহত সেনাসদস্যর জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন, আমিন।
আরো জানুনঃ
কেন একজন সৈনিক দেশের সেরা ও প্রথম শ্রেনীর নাগরিক এবং গর্বীত সদস্য ?
Pingback: সেনাবাহিনীর চিকিৎসা সুবিধা -Bd Military CMH Treatment